প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম-ছোট দেশের বড় বিজ্ঞানী

প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের বেশ কয়েকটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে! স্যার আমার বিভাগের (গণিত, চ বি) চেয়ারম্যানও ছিলেন।

স্যার যখন বক্তব্য দিতেন তখন দেখতাম বড় বড় প্রফেসর স্যারেরাও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।

প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম স্যার দেশকে অনেক ভালোবাসতেন। তাইতো বিদেশের বিত্ত-বৈভব, খ্যাতি ছেড়ে দেশে ফিরে সামান্য বেতনে কর্মে যোগ দেন। গোপনে জামাল স্যার অনেক দান-খয়রাত করতেন বলেও শুনেছি। স্যার মারা গেলে স্যারের জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়ছিল আমার।

শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় স্মরণ করছি মহান বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম স্যারকে।

জামাল নজরুল স্যার সম্পর্কে কিছু তথ্য

তিনি একজন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদ। 

তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত।

ড. ইসলাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল এন্ড ফিজিকাল সায়েন্সের এর গবেষক এবং

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এর একজন সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

জামাল নজরুল ইসলাম স্যার ১৯৩৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানর লরেন্স কলেজে থেকে তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। সে সময় সিনিয়র কেমব্রিজ বলতে বর্তমানের ও লেভেল এবং হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ বলতে বর্তমানের এ লেভেল বুঝাতো।

লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে থেকে বিএসসি অনার্স করেন। কেমব্রিজের প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে আবারও স্নাতক ডিগ্রি (১৯৫৯) অর্জন করেন। তারপর এখান থেকেই মাস্টার্স (১৯৬০) ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৬৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসসিডি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম স্যার।

কর্মজীবন

জামাল স্যার ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

এরপর কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি ) কাজ করেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।

১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে,

১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে এবং

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন।

প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম স্যার ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ) এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন।

১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটি তে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।

এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন।

১৯৮৪ সালে স্যার বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন

তিনি বই পড়তে ভালবাসেন। শখ হিসেবে গান শোনা ও ছবিও আঁকতেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত সবচেয়ে প্রিয় ছিল তাঁর।

কম্পিউটার ও ইন্টারনেট এর প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ক্যালকুলেটর ব্যবহারে তার অনীহা ছিল।

গাণিতিক হিসাব মাথা খাটিয়ে করতে পছন্দ করতেন। তাই কম্পিউটারের ব্যবহারও তার কাছে ভালো লাগত না। এই অপছন্দের মূল কারণ অবশ্য অপ্রয়োজনীয়তা। তিনি বলতেন, কম্পিউটার তাঁর কাজে লাগে না।

তাঁর চিন্তার অনেকখানি জুড়ে ছিল দেশ ও সমাজের উন্নতি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ। নিজের আয় থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করতেন।

তাছাড়া ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার এই পরোক্ষ অবদান ও পরবর্তীকালে দেশে ফিরে আসা থেকে তার দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া তিনি বিদেশে পড়াশোনা করছে এমন সব শিক্ষার্থীকেই পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করতেন সবসময়।

২০০১ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে একটি গুজব রটেছিল। বাংলাদেশেও এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় জামাল নজরুল ইসলাম স্যার গণিতের হিসাব কষে দেখান যে, সে রকম সম্ভাবনা নেই।

কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ এক সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না।

রচনাবলী

১. দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স (১৯৮৩) – কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর বিজ্ঞানী মহলে বিশেষ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। জাপানি, ফরাসি, পর্তুগিজ ও যুগোশ্লাভ ভাষায় অনূদিত হয়।

২. ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪) – ডব্লিউ বি বনোর এর সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন।

৩.রোটেটিং ফিল্ড্স ইন জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৫) – কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত।

৪. অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি (১৯৯২)

৫. কৃষ্ণ বিবর – বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত।

৬.মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ – রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা

৭. শিল্প সাহিত্য ও সমাজ – রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা

স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ – কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত

৮. দ্য ফার ফিউচার অফ দি ইউনিভার্স – এনডেভারে প্রকাশিত

পুরস্কার ও সম্মাননা

বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী স্বর্ণপদক (১৯৮৫)

ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান (১৯৯৪)

ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অফ সায়েন্স পদক (১৯৯৮)

কাজী মাহবুবুল্লাহ এন্ড জেবুন্নেছা পদক পান(২০০০)

একুশে পদক (২০০১)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক (২০১১)

সদস্য

বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি,

রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি,

কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি,

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স,

বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী,

এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ

মৃত্যু

তিনি ফুসফুসের সংক্রমণ ও হৃদরোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ মার্চ ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান। 

Jonayed Hossain

Share this Article:

Facebook
Twitter
LinkedIn