ক্যাডার চয়েস বুঝেশুনে – কালের কন্ঠ

ধরুন, একজন প্রার্থী তিনটি ক্যাডার দিয়েছেন—পুলিশ, কর, কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ। পরে ফলাফল অনুসারে যখন তাঁর সিরিয়াল এলো ততক্ষণে দেখা গেল উল্লিখিত ক্যাডারের পদ পূরণ হয়ে গেছে। যেগুলো খালি আছে, পছন্দক্রমে সেগুলো বাছাই না করায় তিনি কোনো ক্যাডারই পাবেন না। বুঝেশুনে ক্যাডার চয়েস করলে হয়তো তিনি কোনো একটি ক্যাডার পেয়ে যেতেন! বিস্তারিত জানাচ্ছেন ৩৬তম বিসিএস ট্যাক্স (মেধাতালিকায় তৃতীয়) ক্যাডারে কর্মরত মো. জোনায়েদ হোসেন

বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করার শিক্ষাগত, শারীরিক ও অন্যান্য যোগ্যতা পূরণ করতে পারলে আপনি যে বিষয়েই স্নাতক/স্নাতকোত্তর করুন না কেন, সাধারণ ক্যাডার তালিকার সবই পছন্দক্রমে রাখতে পারবেন।কিন্তু প্রফেশনাল/টেকনিক্যাল ক্যাডার তালিকা থেকে কোন কোন ক্যাডার পছন্দ তালিকায় রাখার সুযোগ পাবেন, তা নির্ভর করবে আপনার স্নাতকে পঠিত বিষয়ের ওপর। যেমন—এমবিবিএস/বিডিএস ডিগ্রি সম্পন্ন করা প্রার্থীরা প্রফেশনাল ক্যাডার হিসেবে শুধু স্বাস্থ্য ক্যাডার পছন্দের তালিকায় রাখতে পারবেন। কিন্তু পরিসংখ্যান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা প্রার্থীরা প্রফেশনাল ক্যাডার হিসেবে পরিসংখ্যান ও শিক্ষা ক্যাডার রাখতে পারবেন। আবার পুরকৌশল (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) সম্পন্ন করা প্রার্থীরা টেকনিক্যাল/প্রফেশনাল ক্যাডার তালিকায় গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, রেলওয়ে প্রকৌশল, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল প্রভৃতি ক্যাডার রাখতে পারবেন (কারণ ওপরের চার ক্যাডারের নিয়োগ শিক্ষাগত যোগ্যতায় পুরকৌশল বিষয়ের কথা বলা আছে)।

ক্যাডার বণ্টন প্রক্রিয়া

বিসিএস পরীক্ষার মূল ধাপ তিনটি। ২০০ নম্বরের এমসিকিউ পদ্ধতির প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, এরপর ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা এবং ২০০ নম্বরের ভাইভা। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সব চাকরিপ্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। পরবর্তী সময়ে লিখিত পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ নম্বরপ্রাপ্ত প্রার্থীরা ভাইভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। ভাইভায়ও পাস নম্বর শতকরা ৫০ ভাগ। লিখিত ও ভাইভায় প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে একটি মেধাতালিকা তৈরি করা হয় ক্যাডার বণ্টনের জন্য।

এরপর এই মেধাতালিকা অনুসারে বেশি নম্বরপ্রাপ্ত থেকে ক্যাডার বণ্টন শুরু করে পিএসসি। যিনি সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছেন, তিনি প্রথমে সুযোগ পাবেন। তাঁর চয়েস অনুযায়ী প্রথম চয়েসের ক্যাডারটি তিনি পাবেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম চয়েস যদি সমবায় ক্যাডার হয়, তিনি সমবায় ক্যাডার পাবেন; আবার প্রথম চয়েস যদি পররাষ্ট্র ক্যাডার হয়, তিনি পররাষ্ট্র ক্যাডার পাবেন।

♦ প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে ক্রমানুসারে তাঁদের পছন্দের ক্রম (ক্যাডার চয়েস) অনুযায়ী ক্যাডার পেতে থাকবেন। সব ক্যাডার পদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি চলতে থাকবে। এবার কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পস্ট হবে—

১। ধরুন, যিনি প্রথম হয়েছেন, তাঁর পছন্দের ক্রম কাস্টমস, পররাষ্ট্র, পুলিশ, তথ্য ইত্যাদি। যেহেতু তাঁর সিরিয়াল আগে, তিনি আগে সুযোগ পাবেন এবং যেহেতু এখনো কোনো পদ বণ্টিত হয়নি, সেহেতু তিনি প্রথম পছন্দ কাস্টমস ক্যাডার পাবেন।

২। আরেকজনের কথা বিবেচনা করি, তাঁর ক্যাডার পছন্দক্রম এ রকম—প্রশাসন, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস, পুলিশ, তথ্য ইত্যাদি। মনে করি, তিনি ৪০০তম। এবার ক্যাডার বণ্টনের সময় দেখা গেল প্রশাসন ক্যাডারের পদ বণ্টন শেষ। এরপর দেখবে প্রার্থীর দ্বিতীয় পছন্দ অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস আছে কি না? যদি অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারে তখনো পদ থাকে তাহলে তিনি অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডার পাবেন। আর যদি না থাকে তাহলে তাঁর তৃতীয় পছন্দ ‘পুলিশ’ দেখাবে। এভাবে প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে।  

৩। আরেকজনের কথা বিবেচনা করি, পছন্দক্রমে তিনি শুধু তিনটি ক্যাডার দিয়েছেন—পুলিশ, কর, কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ। মনে করি যখন তাঁর সিরিয়াল এলো, তখন ওপরের তিনটি ক্যাডারের পদ পূরণ হয়ে গেছে। খালি আছে তথ্য, খাদ্য, সমবায় ক্যাডারের পদ। এ ক্ষেত্রে যেহেতু তাঁর পছন্দক্রমে এসব ক্যাডার নেই, সেহেতু তিনি কোনো ক্যাডারই পাবেন না।

৪। ধরুন, একজনের পছন্দক্রম—প্রশাসন, স্বাস্থ্য, পুলিশ ও কর। অর্থাৎ তিনি সাধারণ ও প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল উভয় ক্যাডারে আবেদন করেছেন। সাধারণ ক্যাডারে যখন তাঁর সিরিয়াল আসবে, তখন দেখবে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো পদ খালি আছে কি না। যদি থাকে তাহলে তিনি প্রশাসন ক্যাডার পাবেন। যদি না থাকে তখন তাঁর প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল ক্যাডারের সিরিয়াল বিবেচনা করা হবে। যদি সেখানে পদ খালি থাকে, তাহলে তিনি স্বাস্থ্য ক্যাডার পাবেন। যদি খালি না থাকে তখন আবার সাধারণ ক্যাডার বিবেচনা করা হবে। তখন প্রথমে দেখা হবে পুলিশ ক্যাডারের পদ খালি আছে কি না? এভাবে ক্রমানুসারে বিবেচনা করা হয়।

৫। কেউ যদি শুধু প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল ক্যাডারে (স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রকৌশল, কৃষি ইত্যাদি) আবেদন করেন তাহলে ক্যাডার বণ্টনের ক্ষেত্রে তাঁর সংশ্লিষ্ট ক্যাডারটিই বিবেচনা করা হবে। তিনি কোনো সাধারণ ক্যাডার পাবেন না (মেধাতালিকা অনুযায়ী পদ খালি থাকলেও)।

ক্যাডার চয়েসের সময় বিবেচ্য বিষয়

ক্যাডার পদ কিভাবে বণ্টন করা হয়—এটা বুঝতে পারলে ক্যাডার চয়েস বা পছন্দক্রম ঠিক করা সহজ হয়ে যাবে। ক্যাডার চয়েসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—নিজের আগ্রহ, পরিবার, চাকরির সুযোগ-সুবিধা, কর্মপরিবেশ, কর্মস্থল, পঠিত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা। ক্যাডারগুলো সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে। আবার আমাদের সামাজিক বাস্তবতা ও অন্যান্য কারণে অনেক চাকরিজীবী চাকরিতে যোগদানের পর হতাশায় ভোগেন। পছন্দক্রম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো ভালোভাবে বিবেচনা করে অনলাইনে আবেদন করার আগে একটা খসড়া করে নেওয়া ভালো। ক্যাডার চয়েস দেওয়ার সময় চিন্তা করবেন—আপনার সামনে সব ক্যাডার রাখা আছে। সব কিছু বিবেচনা করার পর আপনি কোন চাকরিটি করতে চান, সেটি ১ নম্বরে দিন। ১ নম্বরের চাকরিটি না পেলে কোন চাকরিটি করতে চান, সেটি ২ নম্বরে দিন। এভাবে আপনি যে চাকরিগুলোর যেকোনোটি হলেই করবেন সব লিস্টে রাখবেন। যে চাকরিগুলো করার সুযোগ পেলেও আপনি করবেন না, শুধু সেগুলো বাদ দেবেন। যেমন ধরুন, এরই মধ্যে আপনি ভালো একটি চাকরি করছেন। পররাষ্ট্র বা প্রশাসন ক্যাডারে কাজ করার আগ্রহ আপনার, অন্য কোনো চাকরি হলেও করবেন না, সে ক্ষেত্রে শুধু এই দুটি ক্যাডারই পছন্দক্রমে রাখবেন। কিন্তু যেকোনো চাকরি হলেই করবেন, সে ক্ষেত্রে সব ক্যাডারই আগ্রহের ক্রমানুসারে লিস্টে রাখবেন।

অনলাইনে আবেদন করার সময় আবেদন ফরমে ব্যক্তিগত তথ্য (পার্ট-১) ও শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য (পার্ট-২) পূরণ করার পর আপনার পছন্দক্রমে রাখতে পারবেন—এ রকম সব ক্যাডারের তালিকা (পার্ট-৩) স্ক্রিনে আসবে। আপনার কাজ হবে ক্যাডারগুলো থেকে পছন্দের একটা ক্রম তৈরি করা।

ক্যাডার চয়েস দেওয়ার সময় বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত পদের সংখ্যা দেখার দরকার নেই। ‘এই ক্যাডারে পদ বেশি, এটা আগে দিব’ এ ধরনের চিন্তা করা বোকামি। আপনি চিন্তা করবেন—সব বিবেচনায় আপনার আগ্রহ কোনটিতে বেশি, পদসংখ্যা যা-ই হোক, সেটি আগে। ভাইভায় ক্যাডার চয়েস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ক্যাডার চয়েসের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো যাঁরা ভাইভা নেবেন, তাঁরাও জানেন। চয়েস দেখে তাঁরা আপনার বিবেচনাবোধ সম্পর্কে একটি ধারণা পাবেন। চেষ্টা করবেন আপনার চিন্তা যেন অদ্ভুত না হয়। আর ভাইভা বোর্ডে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চয়েস থেকেই বেশির ভাগ প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। ক্যাডার চয়েসের ক্রম নিয়ে ভাইভায় প্রশ্ন করা হলে একটি যৌক্তিক কারণ বলার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।

ক্যাডার সম্পর্কে ধারণা

সব ক্যাডার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা এবং যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত, সেগুলো হলো—

১. পররাষ্ট্র : কাজের ধরন, সামাজিক মর্যাদা, বৈশ্বিক উপস্থিতি বিবেচনায় অনেকেই পররাষ্ট্র ক্যাডারকে প্রথমে রাখে। কমসংখ্যক পদে নিয়োগ হয় বলে সাধারণত মেধাতালিকার প্রথম দিকের প্রার্থীরাই পররাষ্ট্র ক্যাডার পেয়ে থাকেন। প্রচুর কাজের চাপের কারণে কেউ কেউ পররাষ্ট্র ক্যাডারকে প্রথমে রাখতে চান না।

২. প্রশাসন ও পুলিশ : বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ এবং ঐতিহ্যের কারণে এ দুটি ক্যাডার বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। কাজের ধরন ও দায়িত্বের কারণে সরকারের কাছেও তাঁদের আলাদা গুরুত্ব থাকে। প্রচুর কাজের চাপ এবং নানাবিধ সংকট মোকাবেলা করতে হয় এ দুটি ক্যাডারে। প্রমোশন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় চাকরিপ্রার্থীরা সাধারণত এ দুটি ক্যাডার চয়েসে সামনের দিকে দেন।

৩. কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ, কর, নিরীক্ষা ও হিসাব : এই তিনটি ক্যাডার অর্থ মন্ত্রণালয়ে কাজ করে। কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ ক্যাডার পরোক্ষ কর (কাস্টমস, এক্সাইজ, ভ্যাট) আর কর ক্যাডার প্রত্যক্ষ কর (আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর) সংগ্রহ করে। নিরীক্ষা ও হিসাব রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাব পরিপালন করে। সুযোগ-সুবিধা, কাজের ধরন, পদায়ন, প্রমোশন ইত্যাদি বিবেচনায় এই তিনটি ক্যাডার অনেকেই প্রথম দিকে রাখেন।

৪. স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, কৃষি, শিক্ষা ও অন্যান্য প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল ক্যাডার : এগুলোর মধ্যে একাধিক ক্যাডারে ইদানীং অনেকেই আবেদন করছেন এবং পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ, কর, নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারে প্রচুর সংখ্যায় যাচ্ছেন। যদি নিজের প্রফেশন পরিবর্তন করতে চান, তাহলে কোন কোন ক্যাডারে আপনার আগ্রহ আছে বা সুযোগ পেলে যাবেন, সেগুলো আগে দিয়ে এরপর প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল ক্যাডার দেবেন। আবার নিজের প্রফেশনেই থাকতে চাইলে পছন্দক্রমে প্রফেশনাল কিংবা টেকনিক্যাল ক্যাডার সাধারণ ক্যাডারের আগে দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে উভয় ক্যাডারে আবেদন না করে কেবল প্রফেশনাল ক্যাডারে আবেদন করাই উত্তম। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অনেক প্রফেশনাল ক্যাডারেই পোস্টিং ও প্রমোশন সমস্যা রয়েছে।

৫. খাদ্য, তথ্য, সমবায়, বাণিজ্য, রেলওয়ে, ডাক, পরিবার পরিকল্পনা : এই সাধারণ ক্যাডারগুলোর কোনোটিতে উপজেলায় পোস্টিং ও প্রমোশন সমস্যা রয়েছে। তবে সরকারের এই সেক্টরগুলোতে ভূমিকা রাখতে ক্যাডার চয়েসের তালিকা সাজাতে পারেন আপনার পছন্দমতো।

Share this Article:

Facebook
Twitter
LinkedIn